গাজীপুরের শ্রীপুরে শিশু স্কুল ছাত্র সাদমান ইকবাল রাকিনকে (১০) অপহরণের পর হত্যার রহস্য উদঘাটন ও দুই আসামীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। রোববার রাতে অভিযান চালিয়ে শ্রীপুরের ফাউগান গ্রাম থেকে হত্যাকান্ডে জড়িত প্রতিবেশী দুই আসামীকে গ্রেফতার করা হয়।গ্রেফতারকৃতরা হলো- নিহত রাকিনের প্রাইভেট শিক্ষক একই এলাকার আলিম সিকদারের ছেলে পারভেজ শিকদার (১৮) ও তার সহযোগী আব্দুল লতিফ মোল্লার ছেলে ফয়সাল আহমেদ (১৬)।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, শ্রীপুর উপজেলার ফাউগান গ্রামের শামীম ইকবালের বড় ছেলে রাকিন গত ৫ ডিসেম্বর আছরের নামাজ পড়তে বাড়ির পাশের মসজিদে যায়। নামাজ শেষে সন্ধ্যায় সে মসজিদ সংলগ্ন মাঠের পাশে বসে শিশুদের খেলা দেখছিল। এসময় সে নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের ঘন্টা খানেক পর অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবী করে রাকিনের বাবাকে মোবাইলে ফোন করে। এর পরপরই সিমটি বন্ধ করে রাখা হয়। অপহরণকারীরা যে সিমটি ব্যবহার করে মুক্তিপণের টাকার জন্য ফোন করে, ওই সিমটি সেটসহ রাকিনের মা প্রায় ৬ মাস আগে হারিয়ে ফেলেন। রাতভর বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করে ছেলের সন্ধান না পেয়ে পরদিন রাকিনের বাবা শ্রীপুর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। নিখোঁজের ৬দিন পর গত ১১ ডিসেম্বর স্থানীয়রা পঁচা দুর্গন্ধের সূত্রধরে বাড়ির পাশে বাঁশঝাড়ের ভিতর রাকিনের অর্ধগলিত লাশ পড়ে থাকতে দেখে। খবর পেয়ে পুলিশ দুপুরে নিহতের লাশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে।
র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান,গেস্খফতার কৃত পারভেজ ২০১৭ সালে স্থানীয় ফাউগান উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাশ করে এবং শিমুলতলী কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এগ্রিকালচার ডিপ্লোমায় ভর্তি হয় এবং তার সহযোগী ফয়সাল ফাউগান উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র। ইতিপূর্বে পারভেজ বিভিন্ন সময়ে ছোট খাট অপরাধমূলক কাজ করেছে বলে র্যাবের কাছে স্বীকার করে। বিগত ২ বছর যাবত ভিকটিম রাকিনকে সে প্রাইভেট পড়াত। বড় অংকের টাকা প্রপ্তির আশায় ০৬ মাস পূর্বে সে ভিকটিম রাকিনকে অপহরণ ও মুক্তিপন চাওয়ার উদ্দেশ্যে রাকিনের বাবার মোবাইলটি তাদের বাসা থেকে চুরি করে। বিভিন্ন অপরাধ বিষয়ক সিনেমা, নাটক বিশেষত ক্রাইম পেট্রোলে দেখে সে এইসব অপরাধমূলক কর্মকান্ড করতে উৎসাহিত হয়ে ওই অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা করে বলে জানায়। সে আরও পরিকল্পনা করে যে, ভিকটিমের বাবার ব্যবহৃত মোবাইলটি হতে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করবে এবং এতে খুব সহজেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দেওয়া যাবে। এমনকি মোবাইলের কল ডিটেলস্ থেকে ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিধায় গত ০৬ মাস সে মোবাইল বন্ধ রেখেছিল এবং অন্য কোথাও কোন কল করেনি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পারভেজ শিকদার তার সহযোগী বন্ধু ফয়সাল আহমেদ এর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। অপহরনের দিন ফয়সাল পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভিকটিমকে খেলার ফাঁকে পাখির বাসা দেখানোর কথা বলে বাঁশঝাড়ের আড়ালে যেতে বলে। কারো সন্দেহের উদ্রেক না হয় এজন্য কিছু সময় পর পারভেজ ও ফয়সাল গোপনে বর্ণিত স্থাানে যায়। তারা ভিকটিমকে কৌশলে বাঁশঝাড়ের আরও গভীরে নিয়ে যায় এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জঙ্গলের ভিতরে ভিকটিমকে আটকে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু জঙ্গলের ভিতর ভিকটিমকে আটকাতে ব্যর্থ হলে এবং ভিকটিম ছাড়া পেলে তাদের কথা সবাইকে জানিয়ে দিবে এই ভয়ে তারা তৎক্ষনাৎ তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেফতারকৃত ফয়সাল প্রথমে ভিকটিমকে মাটিতে ফেলে গলা টিপে ধরে এবং পরবর্তীতে পারভেজ তার শরীরের উপর বসে দুইজন একত্রে রাকিনের গলা টিপে ধরে নৃশংসভাবে হত্যা করে। অপহরণের পর মুক্তিপন চাওয়ার জন্য মোবাইলে কল করতে গিয়ে ফয়সাল দেখতে পায় মোবাইলে কোন টাকা নেই। তখন তারা একত্রে ফাউগান বাজারে জনৈক রনির ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে ২০টাকা ফ্লেক্সিলোড করে। ফ্লেক্সিলোডের রেজিষ্টারে বর্ণিত (চুরিকৃত রাকিনের বাবার মোবাইল) নম্বর লিখলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিধায় ছোট একটি কাগজে (০.৫ ইঞ্চি দ্ধ ২.৫ ইঞ্চি) মোবাইল নাম্বার ও টাকা লিখে ফ্লেক্সিলোড করার জন্য দোকানে দিয়ে তারা দ্রুত চলে আসে। পরে ফয়সাল ভিকটিমের বাবাকে ফোন করে দশ লক্ষ টাকা মুক্তিপন দাবি করে। র্যাব-১ এর তদন্ত দল প্রাথমিকভাবে কোন সূত্র না পেলেও বর্ণিত রনির দোকানের ডাষ্টবিন/ওয়েষ্ট পেপার বক্স থেকে উক্ত ছোট কাগজের টুকরো পাওয়ার পর তদন্ত কার্যক্রম নাটকীয় মোড় নেয়। পরবর্তীতে লাশের পাশে প্রাপ্ত স্টার সিগারেটের প্যাকেট সহায়ক হিসেবে কাজ করে। কাগজের টুকরোর হাতের লেখা, স্টার সিগারেটের প্যাকেট লিখা প্রভৃতির সূত্র ধরে নৃশংস এই হত্যাকান্ডের আসামীদের সনাক্ত করতে সক্ষম হয় র্যাব।
