সহিংসতা শুরুর এক মাস পার হয়ে গেলেও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ এখনও বন্ধ হয়নি। তবে শুরুর দিকে যেভাবে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঢল নেমেছিল, সেটা বন্ধ হয়েছে। এখন কেবল নৌপথে বিচ্ছিন্নভাবে আসছেন রোহিঙ্গারা।বিজিবি বলছে, এখনও দিনে ৭-৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। শনিবার পার্বত্য জেলা বান্দরবানের তুমব্র“ ও ঘুমধুম সীমান্ত, উখিয়ার পালংখালীর আনজুমান পাড়া, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ঘুরে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঢল বন্ধ হওয়ার বিষয়টি দেখা গেছে। তবে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে শাহ পরীর দ্বীপ দিয়ে এখনও আসছেন রোহিঙ্গারা।
এদিকে, তিন লাখ শরণার্থীর হিসাব ধরে জরুরি সহায়তার জন্য প্রাথমিকভাবে যে অর্থ জাতিসংঘ চেয়েছিল, তার অর্ধেকও এখনও জোগাড় হয়নি, অথচ এরইমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হতে চলেছে।জাতিসংঘের ঢাকা অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকভাবে যে ধারণার ভিত্তিতে তারা রোহিঙ্গাদের সহায়তার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক জটিল আকার ধারণ করেছে।গত ৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ জানিয়েছিল, ওই সময় পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গার জন্য সমন্বিত ত্রাণ তৎপরতায় প্রাথমিক হিসাবেই অন্তত ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার প্রয়োজন।এর মধ্যে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৬৪ হাজার ডলার জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে, যা প্রাথমিক পরিকল্পনার ৪৭ শতাংশ।কিন্তু এই সময়ের মধ্যে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মিলিয়ে শরণার্থীর সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে এবং সে অনুযায়ী বেড়ে গেছে চাহিদাও। এই বিপুল জরুরি সহায়তার চাহিদা মেটাতে সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলে ত্রাণ পরিকল্পনা পর্যালোচনা করার কথা জানিয়েছে জাতিসংঘ।এদিকে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগের প্রধান ও জরুরি ত্রাণ সমন্বয়ক মার্ক লোকক এবং ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি লেক সোমবার বাংলাদেশে আসছেন। দুই দিনের সফরে তারা শরণার্থী শিবিরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি ও সঙ্কটের মাত্রা নিজের চোখে দেখবেন। সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে আসছেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিনস।
মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও এবার তারা যে সংখ্যায় এসেছে, তাতে এ অঞ্চলে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে।আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম এবং তাদের সহযোগী সংস্থাগুলো বলছে, বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।এখনও কয়েক লাখ রোহিঙ্গার জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি, তারা একপ্রকার খোলা আকাশের নিচেই দিন কাটাচ্ছে। তাদের কাছে খাবার, চিকিৎসা ও জরুরি সহায়তা পৌঁছে দেওয়াও কঠিন হয়ে উঠেছে ত্রাণকর্মীদের জন্য। প্রতিদিনের বৃষ্টিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জমে যাচ্ছে পানি। সেই পানিই ব্যবহার করছেন অনেক শরণার্থী, যার ফলে কলেরার মত মারাত্মক পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে আইওএম।
রোহিঙ্গাদের জরুরি সহায়তার কাজে সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ইন্টার সেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্র“প (আইএসসিজি) জানিয়েছে, গত পাঁচ সপ্তাহে আসা রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক চাহিদা মেটাতেই এখন প্রতিদিন অন্তত ৫ কোটি ৯০ লাখ লিটার নিরাপদ সুপেয় পানি আর ১৮ হাজার ল্যাট্রিন প্রয়োজন।কিন্তু সাহায্য সংস্থাগুলো এ পর্যন্ত ১ লাখ ৪১ হাজার শরণার্থীর জন্য সুপেয় পানি ও পয়নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। গত ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন সেনা ও পুলিশের চৌকিতে একযোগে হামলা করে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা। এর জেরে সেদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে ২৫ আগস্ট থেকে দলে দলে রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করে বাংলাদেশে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তপথ আছে ২৭১ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলসীমান্ত হচ্ছে ২০৮ কিলোমিটার। আর নাফ নদী দিয়ে নৌপথে সীমান্তপথ আছে ৬৩ কিলোমিটার।২৭১ কিলোমিটার সীমান্তপথের মধ্যে ৪২টি পয়েন্ট আছে যার অন্তত ২২টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।এই ২২টি পয়েন্টের মধ্যে তুমব্র“-ঘুমধুম, টেকনাফের হোয়াইক্যং, উনচিপ্রাং, মংখালী, শাহপরীর দ্বীপ, পালংখালীর আনজুমানপাড়া দিয়ে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এছাড়া পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা ও আশাতলী পয়েন্ট দিয়েও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ছিল।তুমব্র“-ঘুমধুম নিয়ন্ত্রণকারী ৩৪ ব্যাটেলিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লে.কর্নেল মনজুরুল হাসান খান বলেন, তুমব্রু-ঘুমধুম দিয়ে গত ১০ দিনে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা চোখে পড়েনি। কিছু আছে, যারা এদেশে আসার পরও বিভিন্ন প্রয়োজনে আবার সীমান্তের কাছাকাছি যাচ্ছে। তারাই আসছে আর যাচ্ছে। এর বাইরে নতুন করে কেউ আসছে না।নৌপথে শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে বলে জানিয়েছেন বিজিবির টেকনাফ-২ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুর রহমান।
তিনি বলেন, টেকনাফের উত্তরে হোয়াইক্যং, উনচিপ্রাং, মংখালী দিয়ে সেভাবে কোন রোহিঙ্গা এখন আসছে না। দিনে একজনও আসছে না। এখন আসছে শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে। তবে সেটাও কমছে। প্রথমদিকে শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে দিনে ২০ হাজার পর্যন্ত রোহিঙ্গা এসেছে। এখন সাড়ে তিন থেকে চার হাজার রোহিঙ্গা আসছে। রোহিঙ্গা আসা পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে, এটা বলব না। তবে একটা পয়েন্ট, শুধু শাহপরীর দ্বীপ দিয়েই আসছে। বলেন লে.কর্নেল আরিফউখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের পূর্ব ফাঁড়িবিলের বাসিন্দা মো.সোহেল (২২) শুরু থেকে নৌকায় করে রোহিঙ্গাদের আনা-নেওয়ার কাজ করছেন। তবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন আর তাকে আগের মতো নৌকা নিয়ে নাফ নদীতে যেতে হচ্ছে না।
আনজুমান পাড়া সীমান্তে দাঁড়িয়ে সোহেল বলেন, আগের চেয়ে মানুষ অনেক কমে গেছে। এখন দুই-তিনদিনে একবার কিছু সংখ্যক আসছে। নৌকা চালানো আপাতত বন্ধ রেখেছি। আনজুমান পাড়া সীমান্তে একসময় বিজিবির সতর্ক অবস্থান থাকলেও এখন তাদের শুধু টহল দিতে দেখা গেছে।শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ নারীই তাদের শিশুসন্তানদের নিয়ে আসছে। পুরুষদের তেমন দেখা পাওয়া যায়নি। মংডু জেলার সিকদারপাড়া থেকে আসা মাহমুদা বাংলানিউজকে বলেন, স্বামী আমাদের নৌকায় তুলে দিয়ে আবারও ফিরে গেছে। আমি চার ছেলে নিয়ে চলে এসেছি। তিনি বলেন, আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ঘর থাকলে আবারও বর্মায় চলে যেতাম।নাইক্ষ্যংছড়ির ৫০ ব্যাটেলিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ারুল আজিম বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দিনে মাত্র ৫-৭ জন করে অথবা ১-২টি পরিবার আসছে।
