কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, ধান উৎপাদনে দেশের সফলতার ধারাকে আরো গতিশীল করতে হবে। সে লক্ষ্যে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল ধানের জাত ও লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য তিনি ব্রির বিজ্ঞানীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার গাজীপুরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) ৫দিন ব্যাপী বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালা ২০১৫-১৬ এর উদ্বোধনী সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ আহ্বান জানান।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহর সভাপতিত্ত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মনজুরুল হান্নান। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন ব্রির মহাপরিচালক ড. ভাগ্য রানী বণিক। কর্মশালায় ‘গবেষণা অগ্রগতি ২০১৫-১৬’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্রির পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. আনছার আলী। ব্রি’র পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা) ড. মো. শাহজাহান কবীর অনুষ্ঠাণে ধন্যবাদ সূচক বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠাণে ব্রি, বারি, বিএআরসি, ডিএই, ইরিসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। পরবর্তী পাঁচদিন ধরে চলবে কর্মশালার বিভিন্ন কারিগরী অধিবেশন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধান গবেষণা ও সম্প্রসারণ কাজের অর্জন ও অগ্রগতির বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়। কর্মশালার কারিগরী অধিবেশনগুলোতে গত এক বছরে ব্রির ১৯টি গবেষণা বিভাগ ও নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের গবেষণা ফলাফল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সামনে উপস্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ব্রি’র বিজ্ঞানীরা জানান, গত বছর ব্রি পাঁচটি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, যার মধ্যে ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৭, ব্রি ধান৭৮ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৫ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে চারটি আমন মৌসুমে এবং একটি বোরো মৌসুমে চাষ উপযোগী। দেশের অনুকূল পরিবেশে চাষযোগ্য জাত ব্রি ধান৭৫ এর চাল মাঝারি চিকন এবং হালকা সুগন্ধযুক্ত। ব্রি ধান৭৬ ও ব্রি ধান৭৭ অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা এলাকায় চাষ উপযোগী। পক্ষান্তরে ব্রি ধান৭৮ লবণাক্ত জোয়ার-ভাটা এলাকায় চাষ উপযোগী জাত। এ জাতগুলোর গড় ফলন প্রতি হেক্টরে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টন। আর ব্রি হাইব্রিড ধান৫ বোরো মৌসুমে হেক্টরপ্রতি ৯ টন ফলন দিতে সক্ষম। পাশাপাশি ব্রি উদ্ভাবিত দানাদার ইউরিয়া প্রয়োগযন্ত্রটি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানের প্রথম পেটেন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
এগুলোসহ ব্রি গত আট বছরে ৩১টি উফশী ধানের জাতসহ বেশ কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করেছে। উদ্ভাবিত এ জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে লবণাক্ততা সহনশীল বোরো জাত ব্রি ধান৬১ ও ব্রি ধান৬৭, জিঙ্ক সমৃদ্ধ ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৭২ ও ব্রি ধান৭৪, ঐতিহ্যবাহী বালাম চালের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এবং সরু বালাম নামে পরিচিত জাত ব্রি ধান৬৩, সরাসরি বপনযোগ্য আগাম আউশ ধানের জাত ব্রি ধান৬৫, খরা সহনশীল ও উচ্চ মাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ বোরো জাত ব্রি ধান৬৬, বোরো মৌসুমের আদর্শ উফশী জাত ব্রি ধান৬৮ এবং কম খরচে আবাদযোগ্য উফশী জাত ব্রি ধান৬৯ ।
বিজ্ঞানীরা আরো জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রি উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে আরো আছে, দেশে কৃষক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয় এবং বোরো মৌসুমে সর্বোচ্চ ফলন দিতে সক্ষম ব্রি ধান২৯ এর সমপর্যায়ের গুণাগুণ স¤পন্ন ব্রি ধান৫৮ এবং আমন মৌসুমের জনপ্রিয় বিআর১১ এর সমতুল্য ব্রি ধান৪৯। তবে এটি ব্রি ধান২৯ এর চেয়ে প্রায় এক সপ্তাহ আগাম। পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলার লক্ষ্যে ব্রি বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত নয়টি লবণ-সহিষ্ণু, দু’টি জলমগ্নতা সহিষ্ণু, সাতটি খরা সহিষ্ণু, একটি খরা পরিহারকারী, দু’টি শীত সহনশীল এবং চারটি জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। বিভিন্ন ধরনের বৈরী পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার উপযোগী আরো ধানের জাত উদ্ভাবনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ধানের গুণাগুণ বৃদ্ধির জন্য তারা ভিটামিন এ এবং আয়রন সমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবনের কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ব্রি উদ্ভাবিত সরু ও সুগন্ধযুক্ত বোরো মৌসুমের জাত ব্রি ধান৫০ বা বাংলামতি রফতানি সম্ভাবনাময়। বর্তমানে দেশের ৮০ ভাগ জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাতের চাষাবাদ হয় এবং এর থেকে আসে দেশের মোট ধান উৎপাদনের শতকরা ৯১ ভাগ।
ব্রি এ পর্যন্ত পাঁচটি হাইব্রিডসহ মোট ৮২টি উফশী ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে যার মধ্যে বেশ ক’টি প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল এবং উন্নত পুষ্টি গুণ সম্পন্ন। আশা করা যাচ্ছে, এগুলো কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় হবে এবং সামগ্রিকভাবে ধান উৎপাদন বাড়বে।
মোস্তাফিজুর রহমান টিটু, স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর।
