গাজীপুরের শ্রীপুরে রাতে ঘরে ঢুকে মোবাইল চুরি করতে গিয়ে চিনে ফেলায় তিন সন্তানসহ ইন্দোনেশিয়ার বংশোদ্ভুত এক নারীকে কুপিয়ে ও গলা কেটে খুন করা হয়েছে। এসময় দু’মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়। চাঞ্চল্যকর এ চারখুনের মূল হোতা এক কিশোরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। খুন ও ধর্ষণের ঘটনা সে একাই ঘটিয়েছে বলে সোমবার স্বীকারোক্তি দিয়েছে গ্রেফতারকৃত কিশোর। পুলিশ রক্তমাখা গেঞ্জিসহ লুণ্ঠিত মোবাইল ও স্বর্ণালংকার উদ্ধার করেছে। গ্রেফতারকৃতের নাম পারভেজ (১৭)। সে শ্রীপুরের আবদার এলাকার কাজিম উদ্দিনের ছেলে।
শ্রীপুর থানার ওসি লিয়াকত আলী জানান, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের জৈনা বাজার কলেজ রোডের আবদার গ্রামের প্রবাসী রেজোয়ান হোসেন কাজলের দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলা থেকে বৃহষ্পতিবার (২৪ এপ্রিল) সন্ধ্যায় তার বড় মেয়ে সাবরিনা সুলতানা নূরা (১৬), ছোট মেয়ে হাওরিন হাওয়া (১২) ও বাক প্রতিবন্ধী ছেলে ফাদিল (৮) এবং ইন্দোনেশীয় বংশোদ্ভুত তার স্ত্রী ডিসিষ্ট স্মৃতি ফাতেমার (৪৫) গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কাজল বর্তমানে মালয়েশিয়ায় কর্মরত আছেন এবং সেখানে অবস্থান করছেন। এ ঘটনায় কাজলের বাবা আবুল হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামীদের বিরুদ্ধে শ্রীপুর থানায় মামলা দায়ের করেন।
সিআইডি ও পিবিআই গাজীপুর ইউনিট ইনচার্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাসির আহম্দে শিকদার সোমবার সন্ধ্যায় নিজ কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে প্রবাসী কাজলের প্রতিবেশী শ্রীপুরের আবদার এলাকা হতে পারভেজকে আটক করে পিবিআই -এর একটি টিম। আটক পারভেজ পুলিশের কাছে মা ও মেয়েকে ধর্ষণ এবং ওই চারখুনের স্বীকারোক্তি করে ”াঞ্চল্যকর ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। মোবাইল চুরি করতে গিয়ে সে একাই ওই চার খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে পারভেজ জানিয়েছে।
তিনি জানান, চাঞ্চল্যকর চার খুনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পারভেজ জানায়, সে প্রতিবেশী প্রবাসী কাজলের স্ত্রী ও বড় মেয়ের টাচ মোবাইল চুরির উদ্দেশ্যে ২৩ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টার দিকে পিছন দিক দিয়ে ইট বেয়ে কাজলের বাড়ির ছাদে উঠে। পরে কাপড় শুকানোর রশি ছাদের গ্রীলে বেঁধে ওই রশি বেয়ে নীচে দ্বিতীয় তলার বাথরুম দিয়ে ঘরে ঢুকে কাজলের দু’মেয়ের খাটের নীচে প্রায় এক ঘন্টা লুকিয়ে থাকে সে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়েছে ধারনা করে সে খাটের নীচ থেকে বের হয়ে নীচ তলায় যায়। সেখানে রান্না ঘর থেকে বটিদা’ নিয়ে মোবাইল নেয়ার জন্য দোতলায় উঠে কাজলের স্ত্রী ফাতেমার কক্ষের দরজা খোলার চেষ্টা করে পারভেজ। দরজার শব্দে ফাতেমা ঘুম থেকে জেগে উঠে পারভেজকে দেখতে পেয়ে চিৎকার দেয়। এসময় পারভেজ তার হাতে থাকা বটি দিয়ে কাজলের স্ত্রীকে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাথারীভাবে কোপায়। এতে ফাতেমা জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরো , মায়ের চিৎকার শুনে তার তিন সন্তান ঘুম থেকে জেগে উঠলে পারভেজ তাদেরকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। এসময় ফাতেমার ছোট ছেলে আদিলকে গলা কেটে হত্যা করে লাশ খাটের নীচে রেখে দেয়। পরে সে গুরুতর আহত ফতেমাকে ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে তার দু’মেয়ে নুরা ও হাওরিনকে অর্ধমৃতাবস্থায় ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারভেজ সবাইকে গলা কেটে হত্যা করে। এরপর নিহতদের গলার চেইন, কানের দুল, নাক ফুল, আংটি, ফাতেমার দু’টি মোবাইল এবং ডায়েরী নিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে পেছনের গেইট খুলে নিজ বাড়ি চলে যায়। সে বৃহষ্পতিবার রাত সাড়ে ১২টা হতে ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত প্রায় ৫ঘন্টা ওই বাড়িতে অবস্থান করেছে এবং এঘটনা ঘটিয়েছে বলে পুলিশকে জানিয়েছে।
গাজীপুর পিবিআই’র ইন্সপেক্টর হাফিজুর রহমান জানান, গ্রেফতারকৃতের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার গ্রেফতারকৃত পারভেজের ঘর থেকে পায়জামার পকেট হতে লুকিয়ে রাখা উক্ত স্বর্ণালংকার এবং আলনায় অন্যান্য কাপড়ের ভেতর লুকিয়ে রাখা রক্ত মাখা একটি গেঞ্জি ও ২টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
গাজীপুর জেলা আদালতের ইন্সপেক্টর মীর রকিবুল হক জানান, সোমবার বিকেলে গ্রেফতারকৃতকে গাজীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মো. শরীফুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হয়। পারভেজ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আদালতে ১৬৪ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান করে। পরে আদালত গ্রেফতারকৃত পারভেজের জামিন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণ করেন।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরো জানান, গ্রেফতারকৃত পারভেজ ২০১৮ সালে ৭বছরের শিশু নিলীমাকে ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা মামলার চার্জশীট ভুক্ত আসামী। মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করে এবং শ্বাসরোধে শিশু নিলীমার মৃত্যু নিশ্চিত করে ওই পারভেজ।সে ওই মামলায় দীর্ঘ ৯ মাস জেল হাজত বাসের পর কিছু দিন পূর্বে জামিনে মুক্তি পায়।
প্রসঙ্গতঃ ময়মনসিংহের পাগলা থানার লংগাইর ইউনিয়নের গোলবাড়ী গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে রেজোয়ান হোসেন কাজল প্রায় দেড়যুগ আগে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের জৈনা বাজার কলেজ রোডের আবদার গ্রামে দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। এ বাড়িতেই তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতেন। কাজল মিয়া বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন এবং চাকুরি করছেন। মালয়েশিয়ার আগে তিনি ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ১৬ বছর চাকুরি করেন। সেখানে থাকাকালীন কাজল মিয়া ওই দেশের নাগরিক স্ত্রী স্মৃতি ফাতেমা আক্তারকে প্রায় ২০ বছর আগে ভালবেসে বিয়ে করেন। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে কাজল দেশে চলে আসেন। বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায় শ্রীপুরের বাড়ির দ্বিতীয় তলা থেকে কাজল মিয়ার স্ত্রী ও তিন সন্তানের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর।
