গাজীপুরে কালিয়াকৈরের ট্রপিক্যাল নিটেক্স লিমিটেড কারখানার আগুন প্রায় ৪১ ঘন্টা চেষ্টার পর রবিবার বিকেলে নেভাতে সক্ষম হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ২১টি ইউনিটের কর্মীরা। ইতোমধ্যেই পুড়ে গেছে বিপুল পরিমাণ সুতা, ফেব্রিক্স, রপ্তানিযোগ্য ফিনিসড গুডস, কাটিং, সুইং, প্রিন্টিংসহ বিভিন্ন মেশিনপত্র ও মালামাল। আগুনের তাপে ৫ তলা ওই কারখানা ভবনের বিভিন্নস্থানে ফাটল ধরে ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার অভিযোগ তুলে ফায়ার সার্ভিস ও কারাখানা কর্তৃপক্ষ পরস্পরকে দোষারোপ করছেন। এদিকে অগ্নিকান্ডের এ ঘটনায় গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দু’টি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ারম্যান নাসির উদ্দিনসহ অন্ততঃ ১০ জন আহত হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক (পরিকল্পনা) অজিত কুমার ভৌমিক রবিবার অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ কারখানা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানান, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা পল্লীবিদ্যুৎ এলাকাস্থিত মন্ডল গ্রুপের ট্রপিক্যাল নিটেক্স লিমিটেড কারখানার আগুন প্রায় ৩২ ঘন্টা চেষ্টার পর রবিবার সকাল ৮টার দিকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এরপর আগুন পুরোপুরি নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিটের ৪০ জন কর্মী ড্যাম্পিংয়ের কাজ শুরু করেন। তারা বিকেল ৫ টার দিকে আগুন পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হন। ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর, জয়দেবপুর, কালিয়াকৈর, সাভারের ইপিজেড, টঙ্গী, কুর্মিটোলা, বারিধারা, মিরপুর ও তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের ২১টি ইউনিটের কর্মীরা পর্যায়ক্রমে আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়। আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসের ২টি স্নোরকেল (মইওয়ালা) গাড়ি ব্যবহৃত হয়। অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, বিশাল আয়তনের ফ্লোরে আগুন ছড়িয়ে পড়ার শুরুতেই আমাদের খবর জানালে আমাদের পক্ষে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হত। খবর পেয়ে বিভিন্ন ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা শুক্রবার দিবাগত রাত ১টার দিকে কারখানায় আগুন নেভাতে গিয়ে তারা নানা প্রতিক’লতায় পড়েন। আগুনে সুতা ও পোশাক পুড়ে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হওয়ায় এবং কারখানায় চারপাশে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশের প্রশস্ত কোন রাস্তা না থাকায়, আন্ডার কনস্ট্রাকশন একটি বিল্ডিং-এ কারখানাটির অবস্থান থাকায় সেখানে আগুন নেভানোর কাজ বিঘিœত হয়। এছাড়া কারখানার স্ট্রাকচার এমন যে তার ভেতরে পানি পৌছানো দূরহ ব্যাপার। তাই আগুন নিয়ন্ত্রণে নিতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বেশ বেগ পেতে হয় এবং আগুন নেভাতে বেশি সময় লাগে। অতিরিক্ত ঝুকি নিয়ে দুইটি ¯েœার্কেল (মইবাহী) গাড়িসহ ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন স্টেশনের ২১টি ইউনিটের কর্মীরা আগুন নেভান। ওইসব সমস্য না থাকলে আগুন নেভাতে এতো বেশী সময় লাগতো না।
কালিয়াকৈর ফায়ার স্টেশনের স্টেশন অফিসার অপূর্ব বল ও স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার দিবাগত রাত ১২ টার দিকে ওই কারখানার পাঁচ তলা ভবনের তৃতীয় তলায় সুতার গুদামে আগুনের সূত্রপাত হলেও ফায়ার সার্ভিসকে ১২টা ৫৮ মিনিটে খবর দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ। আগুন প্রায় ৫৪ হাজার বর্গফুট আয়তনের ওই গুদামে রাখা বিপুল পরিমান সুতা ও ফেব্রিক্সসহ বিভিন্ন মালামালে ছড়িয়ে পড়ে মূহুর্তেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের আশেপাশের বিভিন্ন স্টেশনের ২১টি ইউনিটের কর্মীরা পর্যায়ক্রমে ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। কিন্তু আগুনের তাপ ও প্রচন্ড ধোয়ার কারনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বেগ পেতে হয়। আগুনের প্রচন্ড তাপে এক পর্যায়ে ওই ভবনের তৃতীয় তলার ছাদ বিভিন্ন স্থানে ধ্বসে পড়লে আগুন চতুর্থ তলায় ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আকার ধারন করে। আগুনে কারখানার ওই ভবনের চারপাশেই বিভিন্ন স্থানে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে এবং প্লাস্টার খসে পড়েছে। এতে ভবনটি ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা শনিবার ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনলেও সকাল ১০ টার দিকে আবারো আগুন বেড়ে ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ চেষ্টার পর ওইদিন সন্ধ্যায় আবারো আগুন আংশিক নিয়ন্ত্রণে আসলেও পরক্ষণেই তা বেড়ে যায়। অবশেষে রাতে আগুনের তীব্রতা হ্রাস পেতে থাকে। টানা প্রায় ৩২ ঘন্টা চেষ্টা চালানোর পর একপর্যায়ে রবিবার সকাল ৮টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তবে আগুন পুরোপুরি নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১০ টি ইউনিটের কর্মীরা ড্যাম্পিংয়ের কাজ শুরু করে। অবশেষে রবিবার বিকেল ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হয়। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ারম্যান নাসির উদ্দিনসহ অন্ততঃ ১০ জন আহত হয়েছে। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে ও ক্লিনিকে পাঠানো হয়েছে।
কারখানার মানসম্পদ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম রিপন জানান, শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে কারখানার তৃতীয় তলায় আগুনের সূত্রাপাত হয়। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়ে আমরাই আগুন নেভানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় সংখ্যক গাড়ি ও সরঞ্জাম নিয়ে যথাসময়ে ঘটনাস্থলে না পৌঁছায় আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরবর্তীতে তা চতুর্থ তলায়ও ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের অনেক স্টেশন থেকেই বিভিন্ন গাড়ি আসে শনিবার ভোর রাতে। এছাড়া মইবাহী গাড়ি দুইটি আসে শনিবার দুপুর দুইটারও পরে। ওই গাড়ি দুইটি আগে আসলে উঁচুতে উঠে তাদের পক্ষে আরো আগে এবং দ্রুত আগুন নেভানো সম্ভব হতো। তিনি আরো জানান, তাদের কারখানা ভবনের স্টাকচার ঠিকই আছে। এতে কোন সমস্যা নেই। আগুনে বিপুল পরিমান সুতা, ফেব্রিক্স, কার্টুন, রপ্তানীর জন্য রাখা ফিনিসড গুডস, কাটিং, সুইং, প্রিন্টিং ও মেশিনপত্রসহ কারখানার বিভিন্ন মালামাল পুড়ে গেছে ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের ডিরেক্টর (অপারেশন) মেজর সাকিল নেওয়াজ জানান, ফায়ার সার্ভিসকে দেরীতে সংবাদ দেয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এছাড়াও অপ্রশস্থ প্রবেশ পথের কারনে প্রয়োজনীয় গাড়ি ও যন্ত্রপাতি নিয়ে অগ্নিস্থলে পৌছতে এবং সুতা ও পোশাক পুড়ে বিষাক্ত ধূয়াসহ গ্যাসের সৃষ্টি হওয়ায় আগুন নেভানোর কাজে বিঘœ ঘটে। ফলে আগুন দীর্ঘস্থায়ী হয়। আগুনে কারখানার ওই ভবনটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
জয়দেবপুর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার হাসিবুল জানান, অগ্নিকান্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তবে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সুত্রপাত হতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি গঠণ ॥
অগ্নিকান্ডের এ ঘটনায় গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দু’টি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মো. রাহেনুল ইসলাম জানান, গাজীপুর কালিয়াকৈরের ট্রপিক্যাল নিটেক্স লিমিটেড কারখানায় আগুনের ঘটনায় গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. রাহেনুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত ওই তদন্ত কমিটির অন্যরা হলেন- সদস্য সচিব শ্রম অধিদপ্তরের কারখানা পরিদর্শক মো. ফরিদ উদ্দিন, শিল্প পুলিশের একজন প্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিসের একজন প্রতিনিধি ও দুর্ঘটনাকবলিত কারখানার একজন প্রতিনিধি।
অপরদিকে ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক (পরিকল্পনা) অজিত কুমার ভৌমিক জানান, অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন) মো. জহিরুল ইসলামকে প্রধান করে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মোস্তাফিজুর রহমান টিটু, স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর।
